সমস্ত লেখাগুলি

বিয়ে করা কি উচিৎ না কি ভুল হবে? -
চার্লস ডারউইন
Nov. 18, 2024 | সমাজ | views:291 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব ভাবছি। আশা করি, এমার তরফেও আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়েটা কি করা ঠিক হবে? করলেও এখনই কি করব না কি পরে? ভাবছেন বিয়ে করা নিয়ে কার এত ভয়, কার এত সংশয়, এত ধন্ধ? কার 'জয় করে তবু ভয় কেন যায়না'? আর কারো নয়, বিবর্তনবাদের জনক স্বয়ং চার্লস ডারুউইনের। যদিও ১৮৩৮ সালের 11 নভেম্বর ডারউইন তাঁর তুতো বোন এমা ওয়েডউডকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং এমা সম্মতি জানান। পরের বছর ২৯ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়। ডারউইন তাঁর বাগদানে পর্বের আগে এই দুটি নোটে বিয়ের উপকার ও অপকার নিয়ে নিজের সাথে প্রবল যুদ্ধ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে করাই ঠিক বলে মনে করেছেন। এরকম একজন মনীষী ও অবিস্মরণীয় প্রতিভারও সাধারণের মত বিবাহ নিয়ে সংশয় বেশ কৌতুক উদ্রেককারী।

প্রথম নোটঃ ১৮৩৮ ৭ এপ্রিলের পরের কোন সময়

যদি বিয়ে না করি- তবে ঘুরে বেড়াতে পারব। ইউরোপ? আমেরিকা ???? ভূতত্ত্বের যাদুঘর অ্যামেরিকায় যাবই। মেক্সিকো যাওয়াটা অবিশ্যি শরীর-স্বাস্থ্য, ক্ষমতা আর প্রাণিবিদ্যায় কতটা পটু হতে পারি, তা দেখে পরে না হয় ভাবা যাবে। আর ভ্রমণ না করলেও, বিভিন্ন প্রজাতি উদ্ভব, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ভূতত্ত্ব নিয়েও কাজ করা যেতে পারে। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করা যেতে পারে।

প্ল্যান বি- লন্ডনে রিজেন্টস পার্কের কাছে ছোট্ট একটা ঘরে থাকব। ঘোড়া থাকবে। গ্রীষ্মে ঘুরেঘুরে প্রাণিবিদ্যা আর ভূতত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করব।

কিন্তু বিয়ে করলে, বাঁধা মাইনের জন্য চাকরি করে যেতেই হবে। লন্ডনের একঘেয়ে জীবন, খালি সামাজিকতা আর সামাজিকতা। দেশ বেড়াতে পারবনা, প্রাণিবিদ্যার নমুনা সংগ্রহ করতে পারব না, বই কেনা হবেনা। ওই কোনক্রমে কেম্ব্রিজে ভূতত্ত্ব বা প্রাণিবিদ্যার প্রফেসারি করেই জীবন কাটাতে হবে। আর এসবগুলো যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে প্রাণিবিদ্যার গবেষণা সুষ্ঠু ভাবে করতেই পারবনা। দেশের মধ্যে এরকম শীতঘুমে জীবন কাটাবার চেয়ে আর একটু ভাল কি কিছু করা যায়না? লন্ডনের কাছাকাছি কোন গ্রামে বেশ রাজকীয় একটা বাড়িতে থাকা যেতে পারে অবশ্য। কিন্তু কিস্যু না করে, ঐ রকম কুঁড়েমি করে তো জীবন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। নাকি, তার চেয়ে লন্ডনেই বন্দিদশা কি মেনে নেব? যদি মোটামুটি টাকা পয়সা করতে পারি, তাহলে লন্ডনে বড়সড় একটা বাড়িতে থাকা যাবে। কিন্তু প্ল্যান বি অনুসারে পয়সা কড়ি হাতে না থাকলে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে কি সেরকম বাড়িতে থাকা যাবে না। সেক্ষেত্রে লন্ডনের কাছের কোন গ্রামই ভাল।কিন্তু গ্রামে থাকা রোজগার আর বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কেম্ব্রিজে থাকা ভাল এক্ষেত্রে, তবে হাতে পয়সা না থাকলে আর প্রফেসারি না করলে, সেখানে আবার অবস্থাটা দাঁড়াবে ঢাঙায় তোলা মাছের মত। নাঃ, কেম্ব্রিজের প্রফেসারিটাই সবচেয়ে ভাল এক্ষেত্রে। এটা করেই যা করার করতে হবে। ঘড়ি ধরে কাজ করব, আর যেটুকু সময় বাঁচবে গবেষণার কাজ করব। যা বুঝতে পারছি, হয় কেম্ব্রিজের প্রফেসার অথবা দারিদ্র এই আমার কপালের লিখন। তবে হ্যাঁ, লন্ডনের উপকণ্ঠে ছোট্ট একটা ঘরে গরীব হয়ে কাটালেও কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু আমার স্বাধীনতা থাকছে।

সরাসরি পর্য্যবেক্ষণের মত আনন্দ আমি অন্য কিছুতেই পাইনা, সেক্ষেত্রে লাইলের (বন্ধু) মত সেই পুরনো ট্রেনে নতুন তথ্য জোড়া আর ভুল শোধরানো কি আমার কিছুতেই ভাল লাগতে পারেনা। লন্ডনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলে একজন কি ভাবে এগোতে পারে, সেই পথটাই তো দেখতে পাচ্ছিনা ঠিকঠাক। এদিকে গ্রামে থাকলে থাকবে, নিম্নস্তরের প্রাণীদের ওপর নানা পর্য্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা নীরিক্ষার সুযোগ আর সময়।

দ্বিতীয় নোট, জুলাই ১৮৩৮

প্রশ্ন সেই একই- বিয়েটা কি করব?

বিয়ে করলে ঈশ্বর কৃপায় বাচ্চারা থাকবে – চিরকালের সঙ্গী আর বৃদ্ধ বয়সের এমন বন্ধু পাব – যার একজনের প্রতিই টান থাকবে – ভালবাসার ও খেলার সঙ্গী পাব — অন্তত কুকুরের চেয়ে তো ভাল। বাড়ি হবে। তার দেখভাল করার একজন লোক হবে। গান বাজনা হবে এবং বৌয়ের সাথে গল্প করা যাবে। এসব একজনের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল। কিন্তু মারাত্মক সময়ের অপচয়।  

হে ভগবান, ভাবা যাচ্ছেনা, যে একজন খালি শ্রমিক মৌমাছির মত সারাটা জীবন খালি কাজ আর কাজ করে অপচয় করবে, আর কিস্যু হবেনা তারপর। না, না , কেউ পারবেনা এরকম। ভাবতে পারা যায়, একজনকে সারাজীবন লন্ডনে ধোঁয়া ভর্তি একটা নোংরা ঘরে একাকী একা কাটিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি- একটু আগুনের উষ্ণতা, সোফায় বসে থাকা সুন্দরী নরম সরম স্ত্রী, কিছু বই আর গান বাজনা- এর উল্টোদিকে গ্রেট মার্লব্রো স্ট্রিটের ঘোলাটে বাস্তবতার কথা ভাবলেই-

না , না, না, বিয়ে করব, করব, করব- নান্য পন্থা

কিন্তু বিয়ে না করলে- যেখানে খুশি যাবার স্বাধীনতা- সমাজিকতার বালাই থাকবেনা- ক্লাবে বুদ্ধিমান লোকেদের সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে- আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে কেউ জোর জবরদস্তি করবে না- ছোটখাট অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে হবেনা - বাচ্চাদের পেছনে খরচ আর উৎকণ্ঠা থাকবেনা- বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে সময় নষ্ট হবেনা- সন্ধে বেলা নিজের মত পড়াশুনো নিয়ে থাকা যাবে- চর্বি বাড়বেনা বসে বসে- উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ব থেকে মুক্তি- তার মধ্যে এক গাদা বাচ্চা কাচ্চা হলে প্রতিটার খোরাকি জোগাড় করতেই সময় চলে যাবে- একজনের পক্ষে এত পরিশ্রম স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই খারাপ। হয়তো বৌয়ের লন্ডন ভালই লাগল না। তারপরের কথাই হল নির্বাসন, আর একজন নিষ্কর্মা মূর্খে পরিণত হওয়া। 


তবুও বিয়েটা করা দরকার। কিন্তু কখন? এখনি না পরে?

মহাজনে বলে বিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা উচিৎ। কম বয়সে লোকের চিন্তা ভাবনা অনেক নমনীয় থাকে, অনুভূতি তীব্র থাকে, তাই সে সময় তাড়াতাড়ি বিয়ে না সারলে, সেই অনাবিল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হবে।  

কিন্তু যদি কালকেই বিয়ে করি, সেক্ষেত্রে আমায় একটা সাজানো গোছানো ভদ্রস্থ বাড়ি পেতে একগাদা টাকা আর অনন্ত ঝামেলা পোয়াতে হবে - সামাজিকতা রক্ষার জন্য নিত্য অশান্তি- সকাল সকাল হাঁকডাক- বিশ্রী সব ব্যাপার স্যাপার- প্রতিদিন সময়ের অপচয়। (বৌ ছাড়া জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে আর পরিশ্রমী করে তোলে)। আমি আমার সব কাজকম্ম করব কিভাবে যদি বৌয়ের সাথে রোজ আমার হাঁটতে বেরোতে হয়? ধুস্‌!! আমি কোনদিন ফরাসীরা কেমন জানতেই পারবনা, এই মহাদেশ দেখতে পাবনা, অ্যামেরিকা যাওয়া পণ্ড- বেলুনে চড়ার বা বেশ একা একা জাহজে করে ওয়েলস যাওয়া বাতিল- ক্রীতদাসের জীবন মাইরি- বা তাদের চেয়েও খারাপ হয়তো- তার ওপর তীব্র দারিদ্র- (বৌ না থাকলে কিন্তু জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে সাথে প্রচুর টাকা)। নাঃ, বালক, এসব ভাবনা ছাড়- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত- এভাবে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন কেউ কাটাতে পারেনা, বিশেষত বৃদ্ধ হয়ে অসুস্থ অবস্থায়, বন্ধুহীন জীবন, ঠাণ্ডা, নিঃসন্তান অবস্থায় পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, যে মুখে এখনি বয়েস থাবা বসাতে শুরু করেছে। বাদ দাও এসব আজেবাজে ভাবনা, একটা সুযোগ দাও নিজেকে- চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখ- অনেক সুখী ক্রীতদাসও দুনিয়ায় চড়ে বেড়াচ্ছে

মূল পাণ্ডুলিপিগুলি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ডারউইন আর্কাইভে রয়েছে- DAR 210.8:2


অনুবাদকের কৈফিয়ত- ডারউইনের নোটদুটি ভাঙা ভাঙা বাক্যে, কখনো একটি দুটি শব্দে নিজের জন্য লেখা- সেভাবে লিখলে পড়ার সুখ থাকবেনা, তাই একদম আক্ষরিক অনুবাদ না করে, কিছু ক্রিয়াপদ বিশেষণ ইত্যাদি জুড়তে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন একটা দুটো শব্দে, সেটা বোঝাও একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আশা করি, যথাযথ বুঝে সেটা সঠিক ভাবে ভাবটা তুলে ধরতে পেরেছি। যদি কিছু ভুল পান, জানাবেন অবশ্যই। 


অনুবাদক- নির্মাল্য দাশগুপ্ত

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929